শেখ গফ্ফার রহমান, একাত্তর নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম ডেক্সঃ
“লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শরীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়মাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারীকা লাক্।” লাখ লাখ কণ্ঠের এই ধ্বনীতে আজ মুখরিত হয়ে উঠবে আরাফাত ময়দান। ঘোষিত হবে মহান আল্লাহর একত্ব ও মহত্ত্বের কথা।
কাফনের কাপড়ের মতো সাদা দু’টুকরো ইহরামের কাপড় পরে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যলাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়বে আল্লাহর বান্দাহগণ।
সৌদি আরবের গ্র্যান্ড ইমাম হাজীদের উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করবেন। আল্লাহ তায়ালা এবং বান্দার মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের অনন্য আবহে বিরাজ করবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্য। এ বছর পবিত্র হজ্জ পালন করার জন্য।
জানা গেছে, আজ সোমবার ফজরের নামাজ মিনায় আদায় করার পর হাজীগণ ইহরাম বাঁধা অবস্থায় আরাফাত ময়দানে এসে অবস্থান গ্রহণ করবেন। অবশ্য অনেকে গত রাতেই আরাফার তাবুতে চলে এসেছেন। এই আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়েই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। লাখো মানুষের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এই ভাষণের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছিল দ্বীনের পরিপূর্ণতা লাভের। আজো সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ভাষণ দেয়া হয়। ভাষণে গোটা বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। আর হাজীগণ এক আবেগঘন পরিবেশে মহান আল্লাহর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেয়ার মন-মানসিকতা নিয়ে কান্নাকাটি করতে থাকেন। তারা নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, নিজের পরিবার পরিজন, সমাজ ও রাষ্ট্রের সুখ শান্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।
বাংলাদেশে আজ ৮ জিলহজ্জ হলেও সৌদি আরবে আজ ৯ জিলহজ্জ। গতকাল সারাদিন ও রাতে হাজীগণ মিনায় অবস্থান করেছেন। আজ ফজরের নামাজ মিনায় আদায় করার পর আরাফার ময়দানে হাজীগণ অবস্থান করবেন। এখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকতে হবে। সূর্যাস্তের পর মুযদালিফার উদ্দেশ্যে আরাফার ময়দান ত্যাগ করবেন এবং মুযদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশা’র নামাজ এশা’র ওয়াক্তে একত্রে পড়বেন এবং সমস্ত রাত অবস্থান করবেন। মিনায় জামরাতে নিক্ষেপ করার জন্য ৭০টি পাথর এখান থেকে সংগ্রহ করবেন। মুযদালিফায় ফজরের নামাজ পড়ে মিনার উদ্দেশে রওয়ানা হবেন।
পবিত্র মক্কা থেকে প্রায় ৯ মাইল পূর্বদিকে একটি পাহাড়ের নাম ‘জাবালুর রহমত’ বা রহমতের পাহাড়। এই পাহাড় সংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রলম্বিত বিরাট প্রান্তরটি আরাফাত প্রান্তর নামে পরিচিত। পাহাড়টি মধ্যম আকৃতির এবং গ্রানাইট শিলা দ্বারা গঠিত। এর উচ্চতা প্রায় ২০০ ফুট। এই পাহাড়ের পূর্বদিকে প্রস্তরের সিঁড়ি রয়েছে। এর ষষ্ঠ ধাপের উচ্চতা বরাবর আগে একটি উন্নত মঞ্চ ও একটি মিম্বর ছিল। এই মিম্বরে দাঁড়িয়ে প্রতি বছর ৯ জিলহজ্জ আরাফার দিন ইমাম সাহেব খুতবা প্রদান করতেন। এখন আর সেই মঞ্চ ও মিম্বার নেই এবং এখান হতে হজ্জের খুতবাও প্রদান করা হয় না। বরং এখন খুতবা দেয়া হয় মসজিদে নামিরা হতে। সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি এ খুতবা প্রদান করবেন।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর মাত্র ১ দিন হাজীরা আরাফার ময়দানে অবস্থান করেন। তখন তাদের পরনে থাকে কাফনের কাপড়ের মতো সেলাইবিহীন সাদা দুই টুকরো কাপড়। হাজীরা আরাফারাতের ময়দানে অবস্থানকালে উচ্চস্বরে লাব্বাইকা পাঠ করেন, যদি সম্ভব হয় হজ্জের খুতবা শ্রবণ করেন। যোহর ও আছরের নামাজ একত্রে এবং মাগরিব ও এশা’র নামাজও একত্রে আদায় করেন, আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করেন, কুরআন তেলাওয়াত, দরূদ ও সালাম প্রেরণ এবং ইহ ও পরকালের কল্যাণ কামনায় অবস্থানকালটি অতিবাহিত করেন।
হযরত আবদুর রহমান বিন ইয়ামার আদ-দায়লি (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আরাফাই তো হজ্জ।” ইমাম শাওকানী (রহঃ) এ কথার ব্যাখ্যায় বলেছেন, “যে ব্যক্তি আরাফাতে অবস্থানের জন্য নির্দিষ্ট দিনে উক্ত ময়দানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য অর্জন করল তার হজ্জ হয়ে গেল। ” ইমাম তিরমিযী (রহঃ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “আরাফাত ময়দানে অবস্থান করার ভাগ্য যার হয়নি তার হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।”
বুখারী ও মুসলিমের এক হাদীসে উল্লেখ রয়েছে হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সাঃ) কে প্রশ্ন করা হলো কোন আমল অধিক উত্তম। তিনি বললেন, আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনা। প্রশ্ন করা হলো, এরপর কোনটি? জবাব দিলেন আল্লাহর পথে জিহাদ করা। পুনরায় প্রশ্ন করা হলো, এরপর কোনটি? উত্তর দিলেন, মকবুল হজ্জ। অন্য হাদীসে হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ্জ করল এবং স্ত্রী সম্ভোগ ও কবিরা গুনাহ থেকে বিরত রইল,, সে মাতৃগর্ভ থেকে সদ্যপ্রসূতের মতো নিষ্পাপ হয়ে প্রত্যাবর্তন করল। বুখারী।
আরও বর্ণিত হয়েছে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, তোমরা হজ্জ ও ওমরাহ পরপর আদায় কর, কেননা এ দু’টি কাজ দারিদ্র্য ও গুনহা নিশ্চিহ্ন করে দেয়, যেমন রেত লোহার মরিচা এবং সোনা ও রুপার ময়লা দূর করে দেয়। আর কবুল হওয়া হজ্জের সাওয়াব জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ।
পবিত্র হজ্জের দিনে হাজিদের নির্বিঘে হজ্জব্রত পালনে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সৌদি সরকার। ইতোমধ্যে প্রায় লক্ষাধিক হজ্জ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, সিভিল ডিফেন্স কর্মী, নিরাপত্তা কর্মী, ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক এবং মিডিয়া কর্মীদের নিয়োগ দেয়াসহ অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারে করে বিশেষজ্ঞ নিরাপত্তা কর্মীরা আকাশে টহল দিচ্ছে বলে জানিয়েছে সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।