এখন প্রায় ঘরে ঘরে জ্বর, সর্দি-কাশি হচ্ছে। অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে নিউমোনিয়ায়। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু-কিশোরদের সংখ্যাই বেশি। তবে জ্বর নিয়ে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। বিশ্রাম, সাধারণ পরিচর্যা ও কিছু ওষুধ সেবন করলে বেশিরভাগ জ্বর এমনিতেই সেরে যায়। জ্বরের অনেক ধরন থাকে। তবে জ্বরকে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন, ভাইরাল জ্বর এবং প্যারাসাইটিক জ্বর সাধারণত এমন পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়।
ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন : ব্যাকটেরিয়াগুলো শরীরের কোষের ভেতর লুকিয়ে থেকে ইমিউন সিস্টেমে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। এগুলোর সংক্রমণে কান ও গলার ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, ট্রাভেলার্স ডাইরিয়া, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, নেফ্রাইটিস ইত্যাদির ফলে জ্বর হয়। রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন থেকে জ্বরে সর্দি, কফ ও শ্বাসকষ্ট থাকে। আবার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনে ঠান্ডা লাগা ভাব থাকে।
ভাইরাল জ্বর : এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে কোনো রোগ ছড়ালে তাকে ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ বলে। ভাইরাল জ্বর হলো তেমনি ছোঁয়াচে রোগ, যা একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ভাইরাল হেপাটাইটিস ‘এ’, ভাইরাল হেপাটাইটিস ‘বি’ ইত্যাদি ভাইরাল জ্বর হয়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। সাধারণত হাঁচি, কাশি, হাই তোলা, লালা, কথা বলা ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগগুলো ছড়ায়। এসব জ্বরের প্রকোপ এখন বেশি।
প্যারাসাইটিক জ্বর : ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, টাইফয়েডের মতো ক্ষতিকর জ্বরগুলো প্যারাসাইটিক জ্বরের পর্যায়ে পড়ে, যা রোগীর জন্য বেশ কষ্টদায়ক। তবে এ সময়ে বেশি হওয়া ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, সর্দি-কাশি-ফ্লুর ধরন, লক্ষণ, করণীয় ও চিকিৎসা সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।
ডেঙ্গু
ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে কয়েক দিনের মধ্যেই সেই ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। বেশিরভাগ ডেঙ্গু ছয়-সাত দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না নিলে ঝুঁকি থাকে।
লক্ষণ
প্লাটিলেট কমে যায়। শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখ লাল হওয়া ও চোখ ব্যথা, চোখ থেকে পানি পড়া, অরুচি বা বমি বমি ভাব ইত্যাদি দেখা দেয়।
বিভিন্ন স্থানে হামের মতো র্যাশ হতে পারে।
হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গু হলে দাঁত ও মাড়ির গোড়া থেকে, নাক দিয়ে বা বমির সঙ্গে, পায়ুপথসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। গায়ে রক্ত জমে ছিটা ছিটা দাগ থাকতে পারে।
করণীয়/চিকিৎসা
টাইফয়েড
সাধারণত ‘সালেমানেলা টাইফি’ ও ‘প্যারাটাইফি’ জীবাণু থেকে টাইফয়েড নামের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা গুরুতর ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের কারণে টাইফয়েড জ্বর হয়ে থাকে। টাইফয়েডের অন্যতম কারণ হলো দূষিত খাবার গ্রহণ।
লক্ষণ
করণীয়/চিকিৎসা
টাইফয়েড হয়েছে কিনা, তা বুঝতে সবার আগে অসুস্থ ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। খাবার গরম করে খেতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করতে হবে।
চিকুন গুনিয়া
ডেঙ্গুর মতোই ভাইরাসজনিত একটি অসুখ চিকুনগুনিয়া। এটি ছড়ায় স্ত্রী জাতীয় এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস মশার কামড়ের মাধ্যমে। চিকুনগুনিয়া হলে শরীরের ১০ বা তারও বেশি জয়েন্টে আক্রমণ করতে পারে। তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ।
লক্ষণ
হাত বা পায়ের আঙ্গুল, গোড়ালি, কবজি, মেরুদন্ড বা অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথার সঙ্গে তা ফুলেও যেতে পারে। জ্বর সেরে যাওয়ার পরও ব্যথা থাকতে পারে।
ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে যায়, রক্তক্ষরণের ঝুঁকি, এমনকি মৃত্যু ঝুঁকিও থাকে, চিকুনগুনিয়ায় এসব থাকে না।
করণীয়/চিকিৎসা
এডিস মশার কামড়ে চিকুনগুনিয়া হয় বলে এ থেকে বাঁচতে এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস ও মশা নির্মূল করা উচিত।
রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে এবং প্রচুর পানি, ফলের জুস বা অন্যান্য তরল খেতে দিতে হবে।
- চিকুনগুনিয়া জ্বর হলে বাড়িতেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এই রোগের নির্ধারিত কোনো চিকিৎসা নেই।
সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট হিসেবে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট। এতে জ্বরের পাশাপাশি ব্যথাও কমে যায়।
ব্যথা বেশি হলে এনএসএইড ছাড়া সাময়িকভাবে ট্রামাডল গ্রুপের ওষুধ দেওয়া যেতে পারে।
গলাব্যথা থাকলে লবণ ও গরম পানি দিয়ে ঘন ঘন গার্গল করতে হবে।ম্যালেরিয়া
সংক্রমিত অ্যানোফিলিস জাতীয় স্ত্রী মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া শুরু হয়। পরে এর জীবাণু লালার মাধ্যমে প্রোস্টেটের সংবহনতন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে এবং যকৃতে পৌঁছে। সেখানে তারা পরিপক্ব হয় এবং বংশবৃদ্ধি ঘটায়।
লক্ষণ
উচ্চমাত্রায় জ্বর, বমি বমি ভাব ও মাথাব্যথা থাকে।
এই রোগের প্রধান লক্ষণ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা, যা ১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে।
মাঝারি থেকে তীব্র কাঁপুনি বা শীত শীত অনুভব।
মাথা ধরা, অনিদ্রা।
রুচিহীনতা বা ক্ষুধামান্দ্য।
কোষ্ঠকাঠিন্য, হজমে গোলযোগ, বমি বমি ভাব বা বমি।
অত্যাধিক ঘাম হওয়া, খিঁচুনি, পিপাসা লাগা ইত্যাদি।করণীয়/চিকিৎসা
কারো ম্যালেরিয়া হয়েছে এমন সন্দেহ হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
রোগটি কোনো ধরনের ম্যালেরিয়ার বিষয়টি নির্ণয় করতে রক্ত পরীক্ষা করালেই জানা যাবে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। তবে তা অবশ্যই ওষুধ শুরু করার আগে হতে হবে।
ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় গেলে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।সর্দি-কাশি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা
হঠাৎ গরম বা ঠান্ডাজনিত আবহাওয়ার কারণে সর্দি-কাশি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা হতে পারে। এটি একটি কমন সমস্যা, যাতে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়।
লক্ষণ
গলাব্যথা, খুসখুসে ভাব, নাক বন্ধ বা অনবরত হাঁচি।
মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ, দুর্বল লাগা ও ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেওয়া।
জ্বর পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে গেলেও সর্দি বা কাশি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
সাইনাস, টনসিলে প্রদাহ, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস হতে পারে। সর্দি বা কাশির সঙ্গে হলুদাভ কফ থাকতে পারে, যা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণকেই নির্দেশ করে।
অ্যাজমার রোগীদের শ্বাসকষ্টও বেড়ে যেতে পারে।করণীয়/চিকিৎসা
ঠান্ডা বা বাসি খাবার ও পানীয়, ধূমপান পরিহার, ধুলাবালি এড়িয়ে চলা।
সতেজ ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান।
চোখ বা নাক মোছার পরপরই হাত ধোয়া।
আদা-লং-এলাচ-লেবু চা, তুলসীপাতা, মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে পান করলে উপকার মেলে।
অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ, প্রয়োজনে কাশির সিরাপ সেবন বা নাকের ড্রপ ব্যবহার করা যায়।
অ্যাজমার রোগীরা ধুলাবালি বা ঠান্ডা এড়িয়ে অ্যালার্জির ওষুধ বা ইনহেলার ব্যবহার করলে ভালো থাকবেন।
গলাব্যথা বা অস্বস্থির ভাব কাটাতে কুসুম কুসুম গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে ঘন ঘন গার্গল করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।