রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট পায় কীভাবে

http://www.71news24.com/2019/03/18/1128

একাত্তর নিউজ ডেস্ক : একের পর এক রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছে। দেশি-বিদেশি চক্রের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গারা। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, পাসপোর্টের এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ কীভাবে সম্পন্ন করছে রোহিঙ্গারা? পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে কয়েক স্তরের যেসব তথ্য ও প্রমাণপত্র সংযুক্ত করতে হয় সেগুলো কীভাবে করা হয়? পাসপোর্টের ক্ষেত্রে অত্যাবশকীয় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) সরেজমিন তথ্য ভেরিফিকেশন বা যাচাই-বাছাইয়ের রিপোর্টেই তবে কি গলদ? এই অপকর্মের নেপথ্যে কি কেবলই দালাল নাকি সংশ্লিষ্ট  দায়িত্বশীলরাও জড়িত সেটি এখন খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
কক্সবাজারে ঠাঁই নেওয়া মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা কেবল বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার নয়, ইয়াবা ব্যবসা ও চুরি-ছিনতাইসহ খুনোখুনির মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়েছে। তবে বিপুল অর্থ ব্যয় করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে যখন বিদেশে পাড়ি জমায় বা জমানোর চেষ্টা করে তখন প্রশ্নবিদ্ধ হয় দেশের ভাবমূর্তিও।
প্রশ্ন উঠছে, তাদের টাকার উৎস এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ভ‚মিকা নিয়ে। অন্যদিকে এসব রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ বিভিন্ন সময়ে নানা অপকৌশলে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টাকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হলেও তাদের বিরুদ্ধে তেমন শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিতেও পারেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আটক করার পর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো অর্থ ব্যয় করে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপদে তাদের পৌঁছে দেওয়া হয়।
চার দিন আগে গত শনিবার বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে সৌদি আরবে যাওয়ার চেষ্টাকালে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক হন রোহিঙ্গা নারী জামিলা (৫৮) ও জোবেদা (৬৩)। তার আগে গত ১৯ মে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে সৌদি আরবে পাড়ি জমানোর চেষ্টাকালে এই শাহজালাল বিমানবন্দর থেকেই তিন রোহিঙ্গা নারীসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা সময়ের আলোকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে পাসপোর্ট করতে গিয়ে এবং বিদেশযাত্রার সময় বিমানবন্দরে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আটকের বিষয়টি পুলিশ সদর দফতরের দৃষ্টিতে এসেছে। এ বিষয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে অবহিত করা হয়েছে।
এআইজি সোহেল রানা বলেন, ভেরিফিকেশনের অংশ হিসেবে আবেদনকারী কর্তৃক দাখিলকৃত জন্মসনদ ও নাগরিকত্ব সনদসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি যাচাই-বাছাই করা হয়। দলিলাদি যাচাই-বাছাইসহ ভেরিফিকেশনের পুরো প্রক্রিয়া অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের আয়োজন করতেও বলা হয়েছে। ভেরিফিকেশনে কোনো গাফিলতি হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে জানান, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পাওয়া এবং বিদেশ পাঠানোর ক্ষেত্রে আট থেকে দশজনের একটি চক্র কাজ করছে। এই চক্রে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, স্থানীয় রাজনীতিক, স্থানীয় প্রভাবশালী দালাল, রোহিঙ্গা নেতা ও বিদেশি এজেন্ট। সবাই মিলে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। একেকজন একেকটি দায়িত্ব পালন করে। কেউ রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে নিজ হেফাজতে রাখে। কেউ ওই এলাকার আঞ্চলিক ভাষা শেখানোর প্রশিক্ষণ দেয়। কেউ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের কাছ থেকে সনদ নিয়ে দিচ্ছে। কেউ পাসপোর্টে এসবির ইতিবাচক রিপোর্ট পাওয়ার ব্যবস্থা করে। এ ছাড়া বিদেশি এজেন্ট ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং সে দেশে অবস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসেন সময়ের আলোকে জানান, রোহিঙ্গা নাগরিকদের দেশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা সাজিয়ে ওইসব এলাকা থেকে দালাল চক্র পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দেয়। এখন পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় এমনটি ঘটাতে পারেনি। এ বিষয়ে কক্সবাজার পুলিশ উদ্বিগ্ন যেমন আছে, তেমনি যথেষ্ট সজাগও রয়েছে। ইকবাল হোসেন জানান, কক্সবাজারের পুলিশকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া আছে, কোনো পুলিশ সদস্যের সহায়তায় কোনো রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করলে তার দায় ওই পুলিশ সদস্যকেই বহন করতে হবে। সেই পুলিশ সদস্যেরও ঠাঁই হবে কারাগারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা ভুয়া নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে পাসপোর্ট বানায়। পরে বাংলাদেশি এই পাসপোর্ট নিয়ে তারা বিদেশে পাড়ি জমায়। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার একটি বাসা থেকে ২৩ রোহিঙ্গা নারীকে উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। যাদের বিদেশে পাচারের জন্য বাংলাদেশি সাজানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। এই চক্রের মূল হোতা হাজি ইব্রাহিম খলিল ও আবদুস সবুর ওরফে রহিমের খোঁজে মালিবাগের একটি বাসায় ডিবি পুলিশ অভিযান চালালেও তাদের পায়নি। তবে সেখান থেকে ৫৪টি পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা পাসপোর্টগুলোর বেশিরভাগ ব্যক্তিকেই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নড়াইল, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, গাজীপুর ও ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এসব পাসপোর্টে দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বরের সঙ্গে পাসপোর্টধারী ব্যক্তির কোনো তথ্যের মিল পাওয়া যায়নি। এরকম ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়েই পাসপোর্ট বানিয়ে অনেক রোহিঙ্গা নাগরিক মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। তবে এদের প্রকৃত সংখ্যা কত তা দায়িত্বশীল কেউ নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি।

Please follow and like us: