একজন করিমুল হকের সংগ্রামী মানবতা 71news24

http://www.71news24.com/2019/03/18/1128

কাজী নূর  (অনুলিখন ) :  জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম ধালাবাড়ি।চারিদিকে চা বাগান আর পাহাড়ি রাস্তা।শহুরে আধুনিক জীবন ছুঁতে পারেনি এই অঞ্চলকে।

 

অধিকাংশ মানুষই পেশায় চা শ্রমিক।দারিদ্রা তাদের নিত্যসঙ্গী।সালটা ১৯৯৫।আজ থেকে ২৪ বছর আগের দিনটার কথা আজও পরিষ্কার মনে আছে ওই গ্রামেরই বাসিন্দা পেশায় সুবর্ণপুর চা বাগানের চা শ্রমিক মোঃ করিমুল হকের।ফিকে হয়নি এতটুকুও।

 

 

রাত তখন এগারোটা হবে।হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন করিমুল হকের মা জফুরান্নেসা।ধালাবাড়ি গ্রাম থেকে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের দুরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার মতো।এমনিতেই রাত।তার ওপর পাহাড়ি জঙ্গলঘেরা সেই পথে এত রাতে যানবাহন কোথায়!তদুপরি ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সেই রাতেই করিমুল ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রামের এ -প্রান্ত থেকে ও -প্রান্ত।যদি কোথাও মেলে যানবাহন।কিন্তু মেলেনি।চোখের সামনেই ছটফট করতে করতেই ভোররাতে মারা যান মা।বিনা চিকিৎসায় মা কে হারানো করিমুল হক সেদিন শপথ নিয়েছিলেন তিনি নিজের জীবন দিয়ে তার গ্রাম ও আশেপাশের অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দেবেন।প্রতিজ্ঞা করেছিলেন গ্রামের আর কাউকে কখনও হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে বাড়িতে পড়ে থেকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেবেন না।

সেই থেকে শুর।প্রথম দিকে বাই সাইকেলে করেই রোগী নিয়ে ছুটতেন হাসপাতালের পথে।রোদ–বৃষ্টি–ঝড়কে উপেক্ষা করে রাতবিরেতে ছুটে গেছেন।চা বাগানে কাজের সূত্রে ম্যানেজারের কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলেন বাইক চালানো।তারপর কখনও কারও থেকে বাইক চেয়ে নিয়ে,কখনও ভ্যান রিকশা বা বাসে চাপিয়েই তিনি গ্রামের নানা প্রান্ত থেকে আসা রোগীদের নিজ দায়িত্বে নিয়ে গিয়েছেন জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতাল।মাসিক ৪০০০ টাকা মাইনে একটা মোটরসাইকেল কেনা সম্ভব ছিলো না।তবু ধারদেনা করে ২০০৭ সালে একটি মোটরসাইকেল কিনে ব্যাপক সাহসিকতার পরিচয় দেন তিনি।আর মোটর সাইকেলের সামনে লাল কালিতে লিখে দেন বিনামূল্যে এ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা দেওয়ার কথা।শুরুর দিকে তাকে অনেক তুচ্ছ তাচ্ছিল্য সহ্য করতে হয়েছে।কিছু লোক তার কাজ দেখে উপহাস করতো।কিন্তু এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না করিমুল।নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে অসুস্থ মানুষকে পিছনে নিজ শরীরের সাথে কাপড় দিয়ে বেঁধে হাসপাতালে পোঁছে দেন।সেই থেকে আজ অবধি এলাকার কাছে -দূরের প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি রোগীকে গ্রাম থেকে হাসপাতাল পৌঁছে দিয়েছেন তিনি।বাঁচিয়ে তুলেছেন হাজারো মুমূর্ষ রোগীকে।ধালাবাড়ির আশপাশের অন্তত ২০টা গ্রামের বাসিন্দাদের একমাত্র ভরসা করিমুলের বাইক এ্যাম্বুলেন্স।

নিজের মস্তিষ্ক প্রসূত কনসেপ্ট বাইক এ্যাম্বুলেন্সের এক পাশে জুড়ে দিয়েছেন ৬ ফুট বাই ২ ফুট একটা কাঠের বাক্স।বাইকেই সর্বদা মজুত অক্সিজেন,স্যালাইন ও ফার্স্ট এইড বক্স।প্রায় কুড়ি বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় তিলে তিলে স্বপ্নকে তিনি সত্যি করেছেন।৫৩ বছর বয়সি করিমুল হক’কে সকলে একডাকে চেনে ‘এ্যাম্বুলেন্স দাদা’ নামে।করিমুলের কথায় মা আমার অনুপ্রেরণা।তা ছাড়া আমি যে চা বাগানে কাজ করি তার মালিক শ্রী সুকুমার দাস আমাকে কাজের ক্ষেত্রে অনেক ছাড় দেন।তাছাড়া পুলিশ ও প্রশাসনের সাহায্য পাই।স্কুলের দিদিমনিরাও অনেক সাহায্য করেন।হাসপাতাল থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসেছেন তিনি বাড়ীতে,ঠিক এমন সময় হয়ত ফের কোনও রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাক পড়ল তার।খাওয়া ওভাবেই রেখে ওই রোগীকে নিয়ে ফের রওনা হয়ে যান হাসপাতালের দিকে করিমুল হক।মা’কে হারিয়েছেন।তাই আর কাউকে হারাতে চান না করিমুল।সমাজসেবা প্রসঙ্গে করিমুল হক বলেন–আমাকে সংবর্ধনা দেওয়ার ক্ষেত্রে কেউ যেন ফুলের মালা না দেন।সেই টাকায় পোশাক কিনে দিলে আমি খুশি হই।খুশি হয় গরিব মানুষ।কারণ ওই পোশাক গরিবদের মাঝে বিতরণ করতে পারি।শুধু জলপাইগুড়িই নয় ডুয়ার্স–সহ গোটা বাংলার মানুষ আজ গর্ববোধ করছেন করিমুল হক’কে নিয়ে।২০১৭ সালে করিমুল হক ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন |

তার দুই ছেলেও তাকে অনুসরণ করছেন।তারাও এ্যাম্বুলেন্স চালান।কোনও মহিলা রোগীর দরকারে তার স্ত্রী সেবা করেন।প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে তিনি নিজেই রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।এজন্য প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছেন তিনি।তার কথায় প্রথম দিকে আমি রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ দিতাম।কিছুদিনের মধ্যে আমি বুঝতে পারি আমার এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।নইলে এর হিতে বিপরীত হতে পারে।এরপর আমি বিভিন্ন কোর্স সম্পন্ন করেছি। নিয়েছি স্থানীয় চিকিৎসকদের কাছেও প্রশিক্ষণ।শিলিগুড়ির এক সার্জনের থেকে সেলাই করাও শিখে নিয়েছেন তিনি।রোগীদের স্টিচ -ওয়াশ সব তিনি নিজেই করেন।এলাকায় একাধিক সমাজসেবামূলক কাজে তার ডাক পড়ে।কোথাও রক্তদান শিবির হলে ডাকা হয় করিমুল হক’কে।আবার কোথাও বস্ত্র বিতরণ হলে ডাক পান তিনি।এছাড়াও চা বাগানের কর্মীদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে থাকেন তিনি।এরই মধ্যে করিমুল হকের কাজে খুশি হয়ে বাজাজ অটোমোবাইল তাকে বিশেষভাবে নকশা করা বাজাজ ভি ১৫ মডেলের একটি মোটরসাইকেল উপহার দিয়েছে।যেটার একপাশে ছাউনিসহ রোগীর শোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।আছে অক্সিজেন সিলিন্ডারও।দেশের প্রত্যন্ত,দুর্গম এলাকায় করিমুলের এই এ্যাম্বুলেন্স বাইক ব্যবহার করা যায় কি না তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় কর্তব্যরত সেনা–কর্মীদের স্বাস্থ্য পরিষেবায় এই বাইক ব্যবহার করতে চাইছে তারা।ইতিমধ্যে ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও) এক প্রতিনিধি দলকে দিল্লি থেকে জলপাইগুড়ি পাঠিয়েছে এর সম্ভাবনা যাচাইয়ে।

কিন্তু এখানেই থেমে থাকতে চাননি এ্যাম্বুলেন্স দাদা করিমুল হক।তার নিজের পৈত্রিক জমিতে স্বপ্নের প্রকল্প দাতব্য ‘মানব সেবাসদন’ এর জন্য অর্থের জোগাড় করছেন ছুটে ছুটে।সরকারি সাহায্য পেলে একবারে সমস্তটার সুরাহা হয়ে যেত,কিন্তু পাননি।তবে তার জন্য বসে থাকতে নারাজ তিনি।তিনি বলেন–আমি মানুষের পাশে দাড়াই।মানুষ আমার পাশে দাড়াবে।এটা আমার বিশ্বাস তাছাড়া এসব তো মানুষের জন্যই।তাই আশা করছি সকলে আমার পাশে থাকবে।হয়তো একটু সময় লাগবে কিন্তু নিশ্চিত তা রূপায়ন হবে।তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন বহু মানুষ,বিভিন্ন ক্লাব ও সংস্থা।প্রতিটি সাহায্যই যে তার কাছে এক একটা ইটের সমান তা নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিলেন তিনি।নিজের দান করা জমিতে তার স্বপ্নের দাতব্য সেবাসদনের জন্য আপাতত তৈরি হয়েছে একটি তলা ভবন।তাতেই রোজ বসছে দাতব্য চিকিৎসালয়।সে ভবনে আরও দু’টি তলা করার ইচ্ছা রয়েছে তার।প্রথম তলায় থাকবে হাসপাতাল।দ্বিতীয় তলায় তিনি করতে চান বৃদ্ধাশ্রম। যদিও বৃদ্ধাশ্রম শব্দটি তার পছন্দ নয়।যাদের সন্তানাদি নেই বা মারা গিয়েছে বা যাদের সন্তানাদি থেকেও নেই একমাত্র তাদেরই ঠাঁই দেবেন তার স্বপ্নের আশ্রমে বলে ঠিক করেছেন তিনি।এখনই ১৭ জন জোগাড় হয়ে গিয়েছে তার।তাদের থাকা খাওয়ার সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছেন।পাশাপাশি একদম উপরের তলে তিনি অতিথিশালা করতে চান।যারা লাটাগুড়ি-গরুমারা ঘুরতে আসবেন তারা এই অতিথিশালায় থাকতে পারেন।এখানে বাইরের হোটেল-রিসোর্ট এর চেয়ে কম ভাড়ায় থাকতে পারবেন।এই অর্জিত টাকা ব্যয় হবে তার হাসপাতালের জন্য।

‘এ্যাম্বুলেন্স দাদা’করিমুল হকের জীবন এবার স্থান করে নিতে চলেছে সেলুলয়েডের ফিতায়।করিমুল হকের জীবনী নিয়ে তৈরি হবে বায়োপিক।ইতিমধ্যেই মুম্বাই থেকে তার বাড়িতে এসেছিলেন পরিচালক বিনয় মুদগলে।চুক্তি পর্বও সেরেছেন তারা।চোখের জটিল রোগে ভুগছেন করিমুল।ডান চোখে অপারেশন হলেও বাম চোখে তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না।অর্থাভাবে চোখের চিকিৎসা পর্যন্ত করতে পারছেন না তিনি।
অভাবের তাড়নায় বেশিদূর পড়তে পারেননি।পড়েছেন ক্লাস ফাইভ সিক্স অবধি।তিনি বলেন–স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বড় কথা নয়।মানুষের পাশে থাকা,মানুষের জন্য কাজ করাটাই বড় কথা।যে শিক্ষা মানুষের জন্য কিছু করতে শেখায় না সে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজের লাভ কী ? প্রশ্ন রাখেন মানব দরদী করিমুল হক।

তথ্যসূত্র—দৈনিক বাংলাদর্পণ

Please follow and like us: