লন্ডন থেকে ছুটে আসেন নিজ খামারে, ছাত্রত্তের নামের পাশে এখন সফল উদ্যোক্তা চট্টগ্রামের ওয়াসিফ

http://www.71news24.com/2019/03/18/1128
একাত্তর নিউজ ডেস্ক ঃ ওয়াসিফ আহমেদ পড়াশোনা করছেন লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে, বিবিএ প্রথম বর্ষে। ছাত্রের এই পরিচয় ছাপিয়ে তিনি এখন উদ্যোক্তা। বেছে নেওয়া পথটাও অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা—পড়ালেখার পাশাপাশি গরুর খামার করেছেন তিনি। ১৯ বছরের এই তরুণ চট্টগ্রাম শহরের কাছেই হাটহাজারী উপজেলার নন্দীর হাটে গড়ে তুলেছেন এশিয়ান অ্যাগ্রো নামে তাঁর নিজস্ব খামার।

লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বর্ষে পড়ছেন চট্টগ্রামের ছেলে ওয়াসিফ আহমেদ। পড়ালেখার পাশাপাশি নিজ এলাকায় একটি গরুর খামার করেছেন তিনি। এবারের ঈদুল আজহায় তাঁর খামার থেকে বিক্রি হয়েছে ১০০টি গরু। এত অল্প বয়সে কীভাবে উদ্যোক্তা হলেন এই তরুণ?

এত কিছু থাকতে গরুর খামার কেন, তা–ও আবার লন্ডনে পড়াশোনার পাশাপাশি? ওয়াসিফের সোজাসাপ্টা জবাব, ‘আমার ইচ্ছাটাই প্রাধান্য দিয়েছি। অবশ্য শুরুতে এত বড় করার ইচ্ছা ছিল না। নিজের জন্য ছোট পরিসরে খামার করব ভেবেছি। একপর্যায়ে তা বড় হয়েছে।’

ওয়াসিফের খামারে কাজ করেন ছয়জন শ্রমিক। ছবি: জুয়েল শীল

ওয়াসিফের খামারে কাজ করেন ছয়জন শ্রমিক।

ব্যবসায়ী পরিবারে বেড়ে ওঠা ওয়াসিফের। বাবা এম এ ছালাম তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এশিয়ান গ্রুপের রয়েছে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, পেপার, অ্যালুমিনিয়াম, হোটেল, রেস্তোরাঁ প্রভৃতি। এরপরও পরিবারের সাহায্য বলতে জমিটুকুই নিয়েছেন ওয়াসিফ। বাকিটা নিজের পুঁজি—কয়েক বছরের জমানো ঈদের টাকা।

ওয়াসিফ শোনান শুরুর গল্প। শখের বশে ২০১৬ সালের নভেম্বরে দুই লাখ টাকা পুঁজিতে খামার শুরু করেন মাত্র চারটি গরু দিয়ে। তখন তিনি চট্টগ্রাম গ্রামার স্কুলের ও লেভেলের ছাত্র ছিলেন। নন্দীর হাটের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান এশিয়ান পেপার মিলের একপাশে পুকুরপাড়ে বেড়া আর টিনের শেড নির্মাণ করে গরু পালন শুরু করেন। মাত্র একজন শ্রমিক রেখেছিলেন দেখাশোনার জন্য। নিজে সপ্তাহের তিন থেকে চার দিন শহরের জিইসি মোড়ের ওআর নিজাম রোডের বাড়ি থেকে খামারে গিয়ে দেখাশোনা করেছেন। ইউটিউবে আধুনিক উপায়ে পশু লালনপালন দেখে নিজেও অনেক কিছু রপ্ত করেন। এক বছরেই সাফল্য আসে। চারটি গরুই ভালো লাভে বিক্রি করেন। পরের বছর গরুর সংখ্যা হয় ১০টি। এবার দুধের জন্য গাভিও যুক্ত করেন। এভাবেই বেড়েছে খামারের পরিসর। এখন গরু রয়েছে ১২০টি। এর মধ্যে ১৫টি গাভি। এসব গাভি থেকে প্রতিদিন ৫০ লিটার দুধ পান, যা বিক্রি হয় স্থানীয় বাজারে।

খামারে একদিন
গুগল ম্যাপের বাতলে দেওয়া পথে চট্টগ্রাম শহরের জিইসি মোড় থেকে অক্সিজেন হয়ে হাটহাজারীর নন্দীর হাটের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। যেতে হয় চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়ক হয়ে। ঈদুল আজহার তিন দিন আগে ৯ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে পৌঁছাই খামারে। সড়ক ঘেঁষেই সাত কানি জায়গার ওপর খামারটি। পুকুরপাড়ে মোট পাঁচটি শেডে রাখা হয়েছে গরু। তখনো কোরবানির জন্য বিক্রি সব পশু ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করা হয়নি। মাঝারি ও বড় গরু বেশি। গরু রাখার শেডগুলোও বেশ আধুনিক মানে। ওপরে ফ্যান, পরিচ্ছন্ন মেঝে। গরুর গোবর প্রতি ঘণ্টায় পরিষ্কার করা হয়। পশুর যত্ন-আত্তিতে যেন কোনো অবহেলা না হয়, সেদিকে নজর রাখা হয়। খামারে এখন একজন ব্যবস্থাপকের তত্ত্বাবধানে ছয়জন শ্রমিক কাজ করেন। পুরো খামার সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

ওয়াসিফ জানান, এবারের ঈদুল আজহায় ৫০ হাজার থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকার মধ্যে তাঁর খামারের ১০০টি গরু বিক্রি হয়েছে। মোট লেনদেন প্রায় এক কোটি টাকা। গরুর ওজন ২০০ থেকে ৯০০ কেজি পর্যন্ত।

প্রতি বছর ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গরু তোলা হয়। এসব গরু সংগ্রহ করা হয় কুষ্টিয়া, রাজশাহী, বগুড়া ও চুয়াডাঙ্গা থেকে। খামারে এসব গরু ১০ থেকে ১২ মাস লালনপালনের পর বিক্রির উপযোগী হয়ে ওঠে।

ওয়াসিফের কাছে প্রশ্ন রাখি, পড়ছেন লন্ডনে, খামার চট্টগ্রামে, তদারকি কীভাবে হয়? বললেন, ‘খামারে সিসি ক্যামেরা থাকায় যেকোনো জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। খামারের অন্যান্য সবকিছু সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এতে গরুর ওজন, সংখ্যা সবকিছু হালনাগাদ থাকে। তা ছাড়া আমি লন্ডনে পড়াশোনা করছি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে। লম্বা ছুটি পেলেই দেশে চলে আসি।’

লক্ষ্যে অবিচল
ছোটবেলা থেকে পশু-পাখির প্রতি আলাদা টান ছিল ওয়াসিফের। তা ছাড়া দাদা ও বাবার হাত ধরে প্রতি কোরবানির ঈদে হাটে যেতেন। এসব একত্র হয়ে খামার গড়ার চিন্তা মাথায় আসে। যখন গরুর খামার করতে চাইলেন, বাড়ির অনেকেই অবাক হয়েছেন। কেউ কেউ ‘গরুর ব্যাপারী’ বলে বিদ্রূপও করেছেন। কিন্তু মা–বাবা দুজনেই গুরুত্ব দিয়েছেন ওয়াসিফের ইচ্ছাকে। সায় দিয়েছেন তাঁর কথায়।

ওয়াসিফ বলেন, ‘মা–বাবার সম্মতি ছিল আমার বড় পাওয়া। এরপর সাহস বেড়েছে। এ ছাড়া বেশি গুরুত্ব দিয়েছি চ্যালেঞ্জ নেওয়াকে। আর কোনো কিছু শুরু করতে গেলে এ রকম বাধা আসতেই পারে। আমার কাছে নিজের সাফল্যটাই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু লোক থাকে, তারা সবকিছুতে নেতিবাচক দিক খোঁজে। ওসব কথায় কান দিলে এগোনো সম্ভব হবে না। সাহস করে শুরু করতে হবে। সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে।’

আছে অনলাইন শপও
খামারের পাশাপাশি ওয়াসিফের রয়েছে ফেসবুকভিত্তিক পাঞ্জাবির অনলাইন শপ। ২০১৭ সালে এই পেজ চালু করেন। মূলত রোজার ঈদে পাঞ্জাবি বিক্রি করেন তাঁর পেজে। গত ঈদে প্রায় ২ হাজার পাঞ্জাবি বিক্রি করেছেন। লেনদেন হয়েছে ১৫ লাখ টাকা।

ওয়াসিফ বলেন, ‘আমি সময় নষ্ট না করে কাজে লাগাতে চেষ্টা করি। হোক তা ছোটখাটো কোনো ব্যবসা। নিজে আয় করার আনন্দ অন্য রকম।’

Please follow and like us: