সোনালী আঁশের বাংলাদেশে বন্ধ করা হলো পাটকল-71news24

http://www.71news24.com/2019/03/18/1128

শেখ গফ্ফার রহমান,  একাত্তর নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম 

পাট উৎপাদনের ইতিহাস আমাদের সেই গত তিনশ বছরের। বাংলার গর্বের ইতিহাস ‘সোনালী আঁশ’। কিন্তু এর যেন কোনো গুরুত্বই নেই। পাটের জায়াগা দখলে করেছে পলিথিন যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, আমাদের শরীরের জন্যও ক্ষতিকর। তারপরও সেটিকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে, প্রমোট করছি অথচ সোনালী আঁশ পাট অবহেলিতই থেকে গেল।

 

পরিবেশের ক্ষতি আসে ধীরে ধীরে। সেই সর্বনাশকে আমরা পাত্তাই দিচ্ছি না। কিন্তু এক পশলা বৃষ্টির পর সব শহর ও নগরীর রাস্তাঘাট যে পানির নিচে তলিয়ে যায় সেটিতো একেবারেই সাক্ষাৎ বিপদ, তার মূল কারণ তো এই পলিথিন বর্জ্য। অথচ কত চমৎকার পরিবেশবান্ধব পাট, আমার সোনার বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল সেটিকে আমরা অদক্ষতা, দুর্নীতি আর চরম অবব্যস্থাপনার কারণে পায়ে ঠেলে দিয়ে আসছি অনেক বছর ধরে।

 

এই পাট উৎপাদনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, কত শিল্পকারখানা। কত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এসব শিল্পকারখানায়। সবকিছুকে তুচ্ছ করে আমরা পায়ে ঠেলে দিয়েছি পুরো পাটশিল্পকে। পায়ে ঠেলতে ঠেলতে সোনালী আঁশ তার সব ঐতিহ্য হারিয়ে হয়েছে পুরোনো দিনে ইতিহাস, হয়েছে এক বেদানার প্রতীক। কৃষক পাট উৎপাদন করে লাভজনক মূল্য না পেয়ে পাটে আগুন ধরিয়ে দেয় আর পাটকলগুলোকে আমরা বন্ধ করে দিই। বন্ধ করে না দিলে জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে এগুলোকে পুষে রাখতে হয়। কত বড় অনিয়ম, কত বড় দুর্নীতি, কত বিশাল অব্যবস্থাপনা! কী নিয়ে আমরা বড়াই করি, কী নিয়ে এত কণ্ঠফাটাই। সীমাহীন অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার চিত্র সর্বত্রই এত প্রকট যে, যেকোনো বিবেকবান ও দেশপ্রেমিক মানুষকে আঁতকে উঠতে হয়।

 

বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসলই ছিল পাট। এই পাট সুনাম কুড়িয়েছিল বিশ্বজুড়ে কারণ বিশ্বের আর কোথাও পাট ফলানোর মতো উর্বর ও উপযুক্ত মাটি প্রকৃতি দেয়নি। এটি ছিল আমাদের গর্বের, আমাদের একক সম্পদ। কিন্তু অযত্ন, অবহেলা, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি আর অনীতির ফলে পাটের আজ এক করুন দুদর্শা! বিশ্বের সর্ববৃহৎ জুটমিলস গড়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জে, যেখানে লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু হায়! আমরা ধরে রাখতে পারলাম না। শুধু অব্যস্থাপনা, দুর্নীতি, অনিয়ম আর অপরাজনীতির কারণে। তৎকালীন সরকারকে আমরা কড়া সমালোচনা করে লিখেছিলাম, কথা বলেছিলাম। কিন্তু এখন কী হলো? আসলে এ তো আমাদের জাতীয় দুর্ভাগ্য।

 

কেউই আমরা পাটের সুনামকে, রাষ্ট্রীয় অব্যস্থানপাকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে পারিনি, পারছি না। আরও দুঃখের বিষয় হচ্ছে পাট উৎপাদনের মাটি হচ্ছে বাংলাদেশ যেখানে সৃষ্টি হয়েছিল (খুলনা, নারায়ণগঞ্জে) বড় বড় পাটকল। লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করতেন এসব মিলে। আয় হতো প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা কিন্তু আমার দেশের সব পাটকল বন্ধ করে, ধ্বংস করে দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে গড়ে উঠছে শত শত পাটকল। এ কেমন রাজনীতি?

দেশের মেহনতি কৃষকদের ঠকিয়ে, দেশের মানুষকে বেকার বানিয়ে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতিয়ারকে পুরোপুরি ধ্বংস করে যে দেশে পাট উৎপাদন হয় না সেখানো আমরা পাটকল গড়ার উৎসাহ ও উদ্দীপনা দিচ্ছি। এ কেমন ব্যবস্থা আমাদের।

 

ধারাবাহিক লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে গেল সরকারী ২৫টি পাটকল। তবে বন্ধের পর সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করে উৎপাদনমুখী করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। দুর্নীতির পাহাড়ের দেশে সেটি কি ভাবে সম্ভব? সেটি হয়তো হবে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট করার আর একটি পন্থা। বন্ধ ঘোষিত পাটকলগুলোর প্রায় পঁচিশ হাজার শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করা হবে। পাটকলগুলোতে কর্মরত ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারী রয়েছেন। ২০১৩ থেকে এ পর্যন্ত আট হাজার ৯৫৪ জন পাটকল শ্রমিক অবসরে গেছেন। অর্থ সংকটে তাদের অবসারভাতা পরিশোধ করা হয়নি।

 

গত ৪৮ বছরে সরকারকে এ খাতে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। ষোল কোটি মানুষের দেশে পাটজাতদ্রব্য বিভিন্ন কাজের জন্য উৎপাদিত হলে, ব্যবহৃত হলে পাটকলগুলোতো লোকসানের মুখে পড়ার কথা নয়। সেটি করার জন্য কি আমাদের কোনো কর্তৃপক্ষ নেই? আমাদের ৩১৪টি পাটকলের মধ্যে ৬৩টি ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ পাটকল সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকল ২৭টি। এর মধ্যে তিনটি ননজুটমিলস রয়েছে। এই সংখ্যা এখন ৩৩টি নতুন ছয়টি যুক্ত হওয়ার কারণে। এর মধ্যে আবার বন্ধ রয়েছে সাতটি। আর বাকিগুলোতে চলছে লুটপাট আর লোকসানের মহামারী যা করোনাভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক।

 

এর কোনো প্রতিষেধক কিংবা ওষুধ কোনো সরকারই বের করতে পারেন নি। বেসরকারীখাতে রয়েছে ২৮১টি পাটকল, যার মধ্যে বন্ধ রয়েছে ৫৬টি। তবে বেসরকারীগুলোতে এত লোকসান হচ্ছে না, কয়েকটিতে ভালো লাভও হচ্ছে। আমরা তো এটি জানি যে, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়ে আসছে বছরের পর বছর।

কিন্তু এ জন্য যারা দায়ী কারা? এবিষয়ে একাত্তর নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম এর সাথে কথা বলেন জাতীয় কৃষক সমিতি’র যশোর জেলার সাবেক সাধারন সম্পাদক মিজানুর রহমান তার সাক্ষাতকার টি তুলেধরা হলোঃ

আমাদের পাট সোনালী আঁশ মানে খ্যাত এমনি এমনি হয়নি, আমাদের পাট গুনে মানে বিখ্যাত। আর সে জন্য আমাদের সোনালী আঁশ হয়ে যায় রাজনীতির বিশেষ অঙ্গ। আমাদের এই পাটকে ধ্বংস করতে কৌশলে ভারতের নিম্ন মানের পাটের বীজ আমাদের কৃষকের হাতে তুলে দেওয়া হয় কালো বাজারের মাধ্যমে। দেশের সব অঞ্চলে কমবেশি এই নিম্ন মানের পাট চাষ হচ্ছে। সরকারের পাট সম্পর্কে নির্দ্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে দেশের পাট চাষীরা বছরের পর বছর ক্ষতিগ্রস্থ হয়, উৎপাদন খরচের সঙ্গে উৎপাদিত পাটের বাজার দরের বড় রকমের ফারাক থাকায় ক্ষতির পরিমান বৃদ্ধি পায় বছর বছর আর কৃষকরা পাট চাষে উৎসাহ হারায়। যাও বা চাষ হতো সেটাও বন্ধ হলো সরকারি পাটকল বন্ধের সঙ্গে।

 

অযৌক্তিক অজুহাতে দেশে সরকারী পাটকল গুলি বন্ধ করে দেওয়া হলো, যুক্তি দেখানো হলো পাটকলে শ্রমিকরা ঠিকমত কাজ করেনা তাই কল গুলো শতশত কোটি টাকা লুকসান গুনছে।

পাটকলে লোকসানের প্রকৃত কারণ কখনোই শ্রমিক নয়, প্রকৃত কারণ বিজেএমসির দুর্নিতি পরায়ন আমলারা, একদিকে তাদের পাহাড় সমান বেতন অন্য দিতে পাট ও পাটজাত পন্য কেনাবেচায় এদিকওদিক করা, মৌসুমে সরাসরি বাজার থেকে কম দামে পাট খরিদ না করে মৌসুম শেষে ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে চড়া দামে পাট কেনা। পাটজাত পণ্য বিক্রয় মুল্য কম করে দেখানো। মজার বিষয় হলো চাকরী হারিয়ে শ্রমিকরা তাদের বউ বাচ্চা নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করলেও আমলারা আছেন শানশওকতে।

 

এবার আসা যাক ব্যাক্তি মালিকানায় পরিচালিত পাটকলে, চলতি বছর দেশের উৎপাদিত সামান্য পাটে যখন কল গুলি বন্ধ হবার অবস্থা তখন মিল মালিকরা পাট আমদানি করলো এবং তা লাগাম ছাড়া চড়া মুল্যে, আমাদের চাষীরা তাদের উৎপাদিত পাটের যে দাম তার তিন গুন বেশি মুল্যে তারপর ও মালিকরা কখনো বলেনি তাদের লোকসান হয়েছে। উপসংহারে এটাই বলা যায় বা এটাই সত্য পাটকলে লোকসান নেই যদি বিজেএমসির আমলাদের দুর্নিতি বন্ধ করা যায়। শুভ বুদ্ধি হোক সরকারের, তাই চালু হোক পাটকল, জীবন ফিরে পাক হাজার হাজার শ্রমিকরা।

Please follow and like us: