৭২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে কপোতাক্ষ নদের ওপর ব্রীজ নির্মাণ করা হচ্ছে, নিচ দিয়ে চলবে না কোন নৌযান-71news24

http://www.71news24.com/2019/03/18/1128

 

শেখ গফ্ফার রহমান, স্টাফ রিপোর্টারঃ

যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ঝিকরগাছায় ৭২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে কপোতাক্ষ নদের ওপর নির্মাণাধীন ব্রিজ নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বর্ষা মৌসুমে ব্রিজের নিচ দিয়ে লঞ্চ বা বড় নৌকা যেতে পারবে না। অন্যদিকে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দাবি, অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ নীতিমালা অনুসরণ না করেই ব্রিজটি নির্মাণ করা হচ্ছে। অভিযোগ আছে, ব্রীজ নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএ’র ছাড়পত্রও নেওয়া হয়নি।

 

ঝিকরগাছা বাজারের গা ঘেঁষে এই ব্রিজটির অবস্থান। দেশের অন্যতম প্রধান স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে এই ব্রীজ সংযোগ করে দিয়েছে দেশের অন্য জেলাগুলোকে।

 

সূত্র জানাযায়, জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে। এজন্য ব্রিজ ও সংযোগ সড়ক নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৭২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এছাড়া, নদের দুই পাড়ে ৯২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই দশমিক ৪ একর জমি ইতোমধ্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকাভিত্তিক যৌথ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মনিকো-ডিএনকো সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ করছে। ২০১৯ সালের ১ জুলাই কাজ শুরু হয়েছে এবং ২০২২ সালের ৩১ মে কাজ শেষ হবে।

 

সূত্র আরও জানায়, পুরোনো সেতুর দৈর্ঘ্য ছিল ১১৫ মিটার, প্রস্থ ৬ দশমিক ২১ মিটার এবং উচ্চতা ৬ দশমিক ১০ মিটার। নতুন সেতুর দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার, প্রস্থ ১১ দশমিক ০৫ মিটার এবং উচ্চতা ৬ দশমিক ৩৪ মিটার। অর্থাৎ পুরোনো সেতুর চেয়ে নতুন সেতুর উচ্চতা শূন্য দশমিক ৩৩ মিটার (প্রায় ১০ ইঞ্চি) বেশি।

 

কপোতাক্ষ পাড়ের বাসিন্দা ঝিকরগাছা মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ মোঃ ইলিয়াস উদ্দীন বলেন, ‘যশোরবাসীর প্রাণের দাবি ছিল পুরোনো ব্রিজ ভেঙে নতুন ব্রিজ তৈরি করার। তবে নির্মাণকাজে নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। আমরা শুনেছি, ১৮ বছরের পানির গড় উচ্চতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিজের গার্ডারের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়। সেইক্ষেত্রে কপোতাক্ষে ব্রিজ নির্মাণে পানি থেকে সেতুর গার্ডারের উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট হওয়ার কথা। কিন্তু নতুন ব্রিজে এই উচ্চতা মাত্র ১৫ ফুট তিন ইঞ্চি। এতে করে বড় নৌ যান চলাচল মোটেও সম্ভব নয়।’

 

 

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নদের ওপর নির্মিত পুরোনা ব্রিজটি ভেঙে সেখানে নতুন ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। নতুন ব্রিজ দুটি অংশ। একটি অংশ নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। ব্রিজটির অপর অংশ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।

 

এদিকে নতুন ব্রিজটিতে ত্রুটি রয়েছে বলে দাবি করেছে বিআইডব্লিউটিএ। সংস্থাটি বলছে, অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনাদি নির্মাণ নীতিমালা অনুসরণ না করে সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে পানি বৃদ্ধি পেলে সেতুর নিচ দিয়ে নৌ যান চলাচল করতে পারবে না। এ অবস্থায় ব্রিজটির দ্বিতীয় অংশ নির্মাণের ক্ষেত্রে বুঝে-শুনে ছাড়পত্র (উলম্ব ও আনুভূমিক) দিতে বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (বাংলাদেশ) প্রকল্প পরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

 

অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনাদি নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০১০ অনুযায়ী দেশে চার শ্রেণীর জলপথ রয়েছে। প্রথম শ্রেণীর জলপথে সারাবছর সর্বনিম্ন ৩ দশমিক ৬ থেকে ৩ দশমিক ৯ মিটার, দ্বিতীয় শ্রেণির জলপথে সারাবছর সর্বনিম্ন ২ দশমিক ১ থেকে ২ দশমিক ৪ মিটার, তৃতীয় শ্রেণীর জলপথে সারাবছর সর্বনিম্ন ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৮ মিটার এবং চতুর্থ শ্রেণির জলপথে শুষ্ক মৌসুমে ১ দশমিক ৫ মিটারেরও কম পানির গভীরতা বিদ্যমান থাকে।

 

বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনও নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তার তীরভূমির ওপর স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে উলম্ব ও আনুভূমিক ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হবে। নিরাপদ এবং সুষ্ঠুভাবে নৌ যান চলাচল নিশ্চিতে প্রথম শ্রেণীর জলপথের ক্ষেত্রে উলম্ব ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যূনতম ১৮ দশমিক ৩ মিটার এবং আনুভূমিক ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যুনতম ৭৬ দশমিক ২২ মিটার। দ্বিতীয় শ্রেণীর জলপথের ক্ষেত্রে উলম্ব ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যূনতম ১২ দশমিক ২ মিটার এবং আনুভূমিক ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যূনতম ৭৬ দশমিক ২২ মিটার। তৃতীয় শ্রেণীর জলপথের ক্ষেত্রে উলম্ব ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যূনতম ৭ দশমিক ৬২ মিটার এবং আনুভূমিক ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যুনতম ৩০ দশমিক ৪৮ মিটার। চতুর্থ শ্রেণীর জলপথের ক্ষেত্রে উলম্ব ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যূনতম ৫ মিটার এবং আনুভূমিক ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যূনতম ২০ মিটার।

 

বিআইডব্লিউটিএ খুলনার পশ্চিম ব-দ্বীপ শাখার যুগ্ম পরিচালক (নৌ- সংরক্ষণ ও পরিচালন) আশরাফ হোসেন গত ১ আগস্ট ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (বাংলাদেশ) প্রকল্প পরিচালককে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ঝিকরগাছায় কপোতাক্ষ নদের ওপর সেতু নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএ’র ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। তার দাবি নদটি চতুর্থ জলপথের আওতায় পড়ে না।

 

তিনি আরও দাবি করেন, নতুন ব্রিজটির উচ্চতা পুরোনো ব্রিজের চেয়ে বেশি। সেতুটি আরও ৫ ফুট উঁচু করা যেতো। তাতে আরও বেশি জায়গা লাগতো। এতে পাশের দোকানপাট নিচে পড়ে যেতো। ঝিকরগাছা পুরো বাজার উচ্ছেদ হয়ে যেতো।

 

উত্তর দিক থেকে আসা কপোতাক্ষ নদ ঝিকরগাছা বাজারের কাছে বাঁক নিয়ে দক্ষিণমুখি হয়েছে। নদের ওপর আড়াআড়িভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে নির্মাণ করা হচ্ছে সেতু। উত্তর পাশে সেতুর একটি অংশের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। সেতুটিতে তিনটি স্প্যান রয়েছে। সেতুর দুই পাশে দুটি এবং মাঝে দুটি-এই মোট চারটি পিলার রয়েছে। সেতুটির দক্ষিণ পাশে অপর অংশের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।

 

এদিকে, নতুন সেতুকে ত্রুটিপূর্ণ ও নির্মাণে সরকারী নিয়মনীতির লঙ্ঘন করা হয়েছে দাবি করে এটি পুনর্নির্মাণের দাবি জানিয়েছে কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন কমিটি। গত ১৯ আগস্ট তারা সেতুর উপরে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে।

 

কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, কপোতাক্ষ নদ খনন শুরু হয়েছে। এছাড়া দর্শনায় ভৈরবের সঙ্গে মাথাভাঙ্গার সংযোগ দেওয়া হলে কপোতাক্ষের গভীরতা বাড়বে। এতে সেতুর নিচ দিয়ে নদে কোনও নৌ যান চলাচল করতে পারবে না।

 

তিনি বলেন, সেতু নির্মাণে যে নীতিমালা রয়েছে, সেটি মেনেই সেতু করতে হবে। সরকারের সিদ্ধান্ত সরকারের আরেকটি পক্ষ বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে লঙ্ঘন করেছে।

 

দ্বিতীয় সেতুর নকশা পরিবর্তন করে বিআইডব্লিউটিএ’র নীতিমালা অনুসরণ করে সেতুটি করার দাবি জানান তিনি।

 

Please follow and like us: